হৃদয়হরণী । পর্ব - ১৯
থাকতে পারে নি ছোঁয়া সাদির কাছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সাদিও বাঁধা দেয় নি৷ কাঁদতে কাঁদতে সাদির কাছে আকুতি মিনতি করেছিলো তাকে রেখে দিতে।
কিন্তু সাদি রেখে দেয় নি৷ সাবিনা সাজ্জাত সেলিম সিমি এবং নাজমা সবার কাছে হেরে গিয়েছে ছোঁয়া। এতোগুলো মানুষ উঠেপড়ে লেগেছে তাকে আলাদা করতে।
সে থাকবে কি করে?
তাই তো থাকতে পারলো না।
তবে ছোঁয়ার মন খারাপ ভ্যানিশ হয়ে গেছে।
কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরলেও রাতেই ছোঁয়ার মনটা ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিলো।
হাজারটা প্রজাপতি উড়েছিলো ছোঁয়ার ছোট্ট মন খানায়।
সাদিকে বিয়ে করতে পেরেও বোধহয় এতোটা খুশি হয়েছিলো না সে।
প্রথমবার চুমু খাওয়াতেও সে খুশি ছিলো না।
কেনো জানি মনে হয়েছে জোর করে চুমু নিয়েছে সাদির থেকে।
সাদি কল করেছিলো তাকে। আদুরে গলায় প্রথমবার "জান" বলে ডেকেছে।
আকুতি ছিলো সেই কন্ঠে। ছিলো পাহাড় সমান মায়া।
ছোঁয়া তো ভুলতেই পারছে না সাদির সেই ভয়েস, সেই আকুতিময় কন্ঠ।
লোকটা পাথর নয় তবে পাথর হয়ে থাকার চেষ্টা করে।
ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে সেদিনের কথোপকথন মনে করতে থাকে।
ছোঁয়া কাঁদছিলো। বুকে বালিশ জড়িয়ে কাঁদছিলো ছোঁয়া।
তখন তার পুতুলের কভার যুক্ত ফোনটা বেজে ওঠে।
স্কিনে "সাদু বেবি" নামটা দেখে অভিমানের পাল্লা ভাড়ি হয়ে ওঠে। ফোন তুলে না।
তুলবেও না বলে প্রতিজ্ঞা করে।
কিন্তু প্রেমিক পুরুষের এতোবার কল করাতে মন গলে যায় ছোঁয়ার।
একবার দুইবার তিনবার এভাবে চল্লিশ বার কল করার পরে ছোঁয়ার ছোট্ট মনটা গলে যায়।
লোকটার ধৈর্য প্রচুর। মানুষ এতোটাও ধৈর্যশীল হতে পারে?
এক চল্লিশ বারের মাথায় ছোঁয়া কল রিসিভ করে কানে তুলে তবে কথা বলে না৷
ভেবেছিলো সাদি ধমক দিবে। বা কড়া কথা শোনাবে।
কিন্তু সাদি সেসবের কিছুই করে না। উল্টে ওপাশ থেকেও নীরবতার আভাস আসে।
দুপাশে দুজন নিরব রয়েছে। একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকে।
এভাবে কতোখন কেটে যায় জানা নেই কারোরই।
হঠাৎ করে সাদির গম্ভীর হৃদয় কাঁপানো শব্দ ভেসে আসে
জাননন
ছোঁয়া কেঁপে ওঠে। ঠিক শুনলো? সাদি তাকে জান বলেছে?
চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে ছোঁয়া। প্রস্তুতি নেয় সাদিকে জিজ্ঞেস করবে " কি বললেন এই মাত্র" কিন্তু ছোঁয়া কিছু বলার আগেই সাদি আবারও সেই সুরেলা মধুর সুরে বলে ওঠে
" জাননন আমার আশেপাশে থাকাটা তোমার জন্য রিক্স। কিছু দিন দূরে থাকার পরে যদি সারাজীবনের জন্য এক সাথে থাকার অনুমতি পাই তাহলে ক্ষতি কি বলো?
ছোঁয়া জবাব দিতে পারে নি। বলতে পারে না "আপনাকে ছাড়া আমি একটা সেকেন্ডও শান্তিতে থাকতে পারি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে"
ছোঁয়াকে নিরব থাকতে দেখে সাদি আবারও বলে ওঠে
"সোনা প্লিজ মন খারাপ করে না।
ছোঁয়া এবারেও জমে যায়। গম্ভীর গোমড়ামুখো সাদি
জান সোনা এসব নামে ডাকতে পারে? এটা বিশ্বাস করার মতো?
আচ্ছা লোকটা ঠিক আছে তো? সে কি নেশা টেশা করেছে?
ছোঁয়ার এসব উজবুক ভাবনার মাঝেই সাদি বলে
"ঘুমিয়ে পড়ো জান"
বলেই কল কেটে দেয়। ছোঁয়া যেনো একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিলো।
সাদিই কি ওর সাথে কথা বললো? এতে সুন্দর করে?
জান, সোনা আবার আদর মাখা শব্দ গুলো?
ভাবতেই পারছে না ছোঁয়া। কেমন পাগল পাগল লাগছে।
তারপর থেকে লোকটা আর কোনো কল করে নি। এক সপ্তাহ কেটে গেলো।
এসেছিলো শুক্রবারে আজকেও আবার শুক্রবার।
তবুও লোকটা এতটুকুও খোঁজ নিলো না। একটু দেখাও হয় না মানুষটার সাথে।
ছোঁয়া কলেজ থেকে প্রায় প্রতিদিন সাদির বাড়িতে যায়।
কিন্তু তাকে পাওয়া যায় না। সাবিনা বেগমের সাথে সময় কাটিয়ে চলে আসে।
সাদি সকাল আটটায় বেরিয়ে যায় সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে।
কেমন পাগল পাগল লাগে ছোঁয়ার। লোকটার চেহারা যেনো চোখের শান্তি।
চোখ দুটোকে শান্তি দিতে পারছেই না।
আজকে সকাল থেকে ছোঁয়া ভেবে রেখেছে সাদির বাড়িতে যাবে।
কিন্তু বেরুনোর সুযোগই পাচ্ছে না।
এই তো সকালে সিমি পরিকে ছোঁয়ার কোলে তুলে দিলো।
আর বললো "পরি ঘুমবে তুই একটু হেঁটে হেঁটে ঘুম পারিয়ে দে। আমি কাজ করছি"
ছোঁয়া পরিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তারপর যাবে মমতা বেগম ধরেছে ছোঁয়াকে।
কাছে বসিয়ে আদর করে খাওয়াতে থাকে। ছোঁয়া না কি শুকিয়ে যাচ্ছে ঠিক মতো খায় না।
দাদির কথা শুনে ছোঁয়া মুখ ফসকে বলে ফেলে
"বিয়ে হয়েছে তবুও জামাই ছাড়া থাকছি। রোগা হবো না?
জামাইয়ের চিন্তায় রোগা হয়ে যাচ্ছি"
মমতা এক গাল হাসে।
বড় হও দাদুভাই। তারপর জামাইয়ের চিন্তা করো।
যথেষ্ট বড় আমি। আমার একটা ফ্রেন্ডের বাচ্চা হয়ে গেছে।
সেখানে আমি শোক পালন করছি"
সিফাত কেশে ওঠে। সেও খাচ্ছিলো। মূলত সিফাতকে ছোঁয়া খেয়াল করে নি।
ভাড়ি লজ্জায় পড়ে যায় ছোঁয়া।
আর একটাও বাক্য মুখ থেকে বের করে না চুপচাপ খেতে থাকে।
খাওয়া শেষে নিজের রুমে ঢুকে একটু সাজুগুজু করে নেয়।
কতোদিন পরে বরটার সাথে দেখা করতে যাবে একটু সাজুগুজু না করলে চলে?
ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো শেষ হতেই ডাক পড়ে সেলিমের। ভাড়ি বিরক্ত ছোঁয়া।
এবার বাবা ডেকে নিয়ে হাজারটা উপদেশ দিবে। আর তার উপদেশের মূল মন্ত্য হলো সাদি।
সাদির সাথে তোমাকে মানায় না।
তুমি চাইলে আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো
তুমি আরও ভালো ডিজার্ভ করে ব্লা ব্লা ব্লা
ছোঁয়া মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয় মাঝেমধ্যে হেসে ফেলে৷ আসলে বাবা মানুষের ইনকাম আর চেহারাকে বেশি পাধান্য দেয়। সাদির রোজগার কম। বয়স বেশি এটাই সমস্যা তার।
ছোঁয়া বাবার ডাকে সাড়া দেয় না। সে তার মতো ধীরে সুস্থে রেডি হতে থাকে।
ফোনের ব্যাক কভারে কিছু টাকা ভরে গলায় ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বেশি দূরে না হওয়াতে ছোঁয়া পায়ে হেঁটেই রওনা হয়।
দুটো রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় সাদির ফ্লাইটে।
একটা হচ্ছে মেইন রোড। যেখানে সারাক্ষণ যানবাহন চলতে থাকে মানুষের সরগম।
আরেকটা হচ্ছে কাঁচা রাস্তা। যেখানে মানুষের চলাচল খুবই কম৷ তবে রাস্তাটা সুন্দর।
মাটির রাস্তা দুই পাশে গাছপালা দিয়ে ভর্তি।
এই রাস্তার সাথে ছোঁয়া দুই দিন আগে পরিচিত হয়েছে।
যেদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সাদির বাসায় গিয়েছিলো সাদিকে দেখতে।
কিন্তু গিয়ে দেখে জনাব বাসায় নেই।
সাবিনা বেগম রান্না করছে।
এক প্রকার রাগ করেই বাসা থেকে বেরিয়েছিলো সে।
ভেবেছিলো হারিয়ে যাবে৷ যাতে সাদি তাকে খুঁজে।
সেই জন্য এই রাস্তা ধরে হাঁটছিলো।
কিন্তু সে লাউ সেই কদু।
এই রাস্তা তাকে একদম বাড়ির সামনে এনে থামিয়েছে।
ছোঁয়ার আর হারিয়ে যাওয়া হলো না৷
কলিং বেল এক নাগারে বাজিয়েই চলেছে ছোঁয়া।
তার মন খুঁত খুঁত করছে যদি আজকেও সাদির দেখা না পায়?
তখনই ফট করে দরজা খুলে যায়।
সামনে তাকাতেই ছোঁয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
কারণ তার সামনে স্বয়ং তার চোখের শান্তি দাঁড়িয়ে আছে৷
ছোঁয়া এক গাল হেসে বলে
"আজকে আমি এখানে থাকবোই থাকবো।
প্রধানমন্ত্রী আসলেও আমাকো নরাতে পারবে না।
এ আমি কাঠ কাঠ বলে দিলাম।
বলেই সাদির হাতের ফাঁক দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে।
বড় মা বড় মা বলে ডাকতে থাকে সাবিনা বেগমকে।
সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করে ছোট্ট করে জবাব দেয়
মা মাত্রই চলে গেলো।
এটা শুনে ছোঁয়া লাফিয়ে ওঠে।
"উফফফফ আজকে প্রকৃতিও চাইছে আমি এখানে থেকে যাই।
আমি চাইছি না
সাদি গম্ভীর গলায় বলে। ছোঁয়া ভেংচি কাটে
তা চাইবেন কেনো? নিরামিষ কি না আপনি?
অসভ্য ব্যাডা। একদিন কল করে জান সোনা বলে তারপর থেকে লাপাত্তা।
বলি কেউ কি আপনার গলায় চা*কু ঠেকিয়ে আমাকে জান বলিয়েছিলো?
সাদি বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে নিজের রুমে চলে যায়।
ছোঁয়া ভেংচি কেটে সোফায় বসে পড়ে।
চলবে...